Banglar Unnoyon :: বাংলারউন্নয়ন.নেট

ঘাস আবাদে গ্রামের দারিদ্র্য দূর

নিউজ ডেস্ক

বাংলারউন্নয়ন.নেট কম

প্রকাশিত : ১১:২৬ এএম, ৩ এপ্রিল ২০২১ শনিবার

শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও বাস্তবে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার একটি গ্রামের প্রধান ফসল ঘাস। গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কিশোরবাড়ী ইউপির সুলতানপুর বাড়াইপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির উঠান, বাড়ির পিছনে পরিত্যক্ত জমিতে কৃষকরা লাগিয়েছেন নেপিয়ার জাতের ঘাস।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের গ্রামের ২০০ জন কৃষকের মধ্যে ১৫০ জনই ঘাস চাষ করেন। আর এই ঘাস চাষের মাধ্যমেই বদলে যাচ্ছে এলাকার কৃষকদের আর্থ সামাজিক অবস্থা।

কৃষকরা জানান, ১৮-২০ বছর আগে সুলতানপুর বাড়াই গ্রামের আব্দুল গফুর প্রথমে এই ঘাস চাষ করে সাফল্য পান। এরপর ওই এলাকার কৃষকরা অন্য ফসলের পরিবর্তে ঘাস চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হন। আস্তে আস্তে ঘাস ছড়িয়ে পরে উপজেলার ৩০-৪০টি গ্রামে। শুধু তাই নয়, পুরো গাইবান্ধা জেলার সাতটি উপজেলার হাজারো কৃষক এখন চাষ করছেন গবাদিপশুর খাদ্য নেপিয়ার ঘাস।

আবদুল গফুরের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ২০ বছর আগে আমি ছিলাম একজন হতদরিদ্র দিনমজুর। ক্ষুধা-দারিদ্র এবং ঋণে জর্জরিত ছিল ছয় সদস্যের সংসার। এসময় আমার গ্রামের এক স্কুলশিক্ষক আমাকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পরের দিন আমি তাই করলাম।

তখন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আমাকে নেপিয়ার ঘাসের কিছু চারা দিয়েছিলেন এবং এটি চাষ করতে বলেছিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমি ঘাস চাষ করলে কী হবে? জবাবে তিনি বলেছিলেন- এটা তোমার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাবে। তার পর থেকে আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

তিন ছেলেকে নিয়ে এখনো ২০ বিঘার মতো জমিতে ঘাস চাষ করেন আব্দুল গফুর। নেপিয়ার এবং সুপার নেপিয়ার-পাঞ্চচোগ-১ (হাইব্রিড) জাতের ঘাস চাষ করছেন তারা। 

ঘাস চাষে কীভাবে এত লাভ করছেন জানতে চাইলে বলেন, বাংলাদেশের অন্য যে কোনো ফসলের তুলনায় ঘাসের চাষ কম ব্যয়বহুল। কোনো কীটনাশক লাগে না। জমিতে সেচ কম লাগে। একবার কোনো জমিতে ঘাস লাগালে পরের টানা তিন বছর ধরে ফসল পাওয়া যায়। যদি এক বিঘা জমিতে নেপিয়ার চাষ করা যায় তবে প্রতি মাসে সেখান থেকে ঘাস কাটা যায়। এক বিঘা জমি থেকে ৩ হাজার আটি (৫-৬ কেজি ওজনের) ঘাস কাটা যায়, যার বর্তমান বাজারমূল্য ২০-৩০ হাজার টাকা (প্রতি আটি ৮-১০ টাকা)। এক বছরে এইভাবে একই জমি থেকে ৭-৮ বার ঘাস কাটা যায়। প্রতি বিঘা জমিতে বছরে খরচ হয় ৩০-৪০ হাজার টাকা আর লাভ হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা।’

তবে ২০০০ সালের দিকে গফুর যখন ঘাস চাষ শুরু করেন তখন গ্রামের লোক তার সমালোচনা করতে শুরু করেন। এমনকি তার নাম বদলে রাখা হয় ‘ঘাস গফুর’। তবে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। ঘাস চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য আব্দুল গফুর বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পেয়েছেন ২০১৪ সালে।

আশেপাশের গ্রামের কৃষকরা জানান, যারা সবাই এখন ঘাস চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন এবং এলাকায় ঘাস চাষের প্রচলন করার জন্য আব্দুল গফুরের প্রশংসা করেছেন।

তার সাফল্য অনুসরণ করে সুলতানপুর বড়াইপাড়া ও সংলগ্ন প্রজাপাড়া, দিঘলকান্দি, বড় শিমুলতলা, কাছারিপাড়া, আশমতপুর, লোকমানপুর, কিশোরগাড়ি, কাসিয়াবাড়ী, কাতুলি এবং বেনগুলিয়া গ্রামের কয়েক হাজার কৃষক এখন ঘাস চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন বলে জানিয়েছেন তারা।

সুলতানপুর বড়াইপাড়া গ্রামের কৃষক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, আগে অন্যান্য ফসল যেমন তুলা, কলা, মরিচ, টমেটো এবং বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির আধিপত্য ছিল। তবে এখন নেপিয়ার সুলতানপুর এবং প্রজাপাড়া গ্রামের প্রধান ফসল।

প্রজাপাড়া গ্রামের কৃষক মইনুল ইসলাম বলেন, নেপিয়ারের চাষ আমাদের এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করেছে। এই এলাকার কৃষকরা শুধু ঘাসই চাষ করছে না, একইসঙ্গে গরুও পালন করছে। গ্রামের প্রত্যেক কৃষকের বাড়িতে আপনি গরু দেখতে পাবেন। পাশাপাশি প্রত্যেকের রয়েছে একটি করে ভ্যান, যাতে করে কৃষকরা ঘাস নিয়ে যায় এলাকায় হাট-বাজারগুলোতে। কারো জরুরি টাকার প্রয়োজন হলে ঘাস বিক্রি করে সেই টাকার বন্দোবস্ত করে। এমনকি গতবছর এই এলাকায় তিন-চার দফায় বন্যা হয়। বন্যায় আমাদের এলাকায় খড়ের খুব অভাব হয়, তখন এই ঘাস আমাদের গবাদি পশুদের রক্ষা করেছে এবং অনেকে ভালো লাভও করেছে ঘাস বিক্রি করে,’ বলেন আরেক কৃষক সুরুজ মিয়া।

পলাশবাড়ী উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আলতাব হোসেন বলেন, গত ১০ বছরে এই এলাকায় নেপিয়ার ঘাস চাষ বেড়েই চলছে। জেলার মোট ঘাসের ৪০ শতাংশ এই উপজেলায় চাষ হয়। এমনকি এই ঘাস চাষের ফলে কমেছে ক্ষতিকর তামাক চাষ।

গাইবান্ধা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মাছুদার রহমান সরকার বলেন, জেলায় এখন মোট ঘাসের আবাদি পরিমাণ ৩৭৩ হেক্টর। আস্তে আস্তে সারা জেলায় ঘাস চাষের পরিমাণ বাড়ছে। এমনকি যাদের নিজের জমি নেই তারা রাস্তার দুই পাশেও ঘাসের চাষ করছেন।